স্বদেশ ডেস্ক: বিশ্বনন্দিত ফুটবল সাংবাদিক ব্রায়ান গ্ল্যানভিল একবার লিখেছিলেন, দিয়েগো ম্যারাডোনা হলেন ফুটবলের সেই ছুরি যা দিয়ে মসৃণভাবে রুটির ওপর মাখনের পালিশ দেয়া যায়, ফল কাটাও যায়, আবার মাংস দ্বিখণ্ডিতও করা যায়। ম্যারাডোনার ফুটবলকে এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন গ্ল্যানভিল। ফ্রান্স বিশ্বকাপের সময় প্যারিসের মিডিয়া সেন্টারে দাঁড়িয়ে এই গ্ল্যানভিলই আমাদের মতো দেশ- বিদেশের তরুণ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পেলে যদি হন ব্যারেলে রাখা ভিনটেজ মদ, ম্যারাডোনা তাহলে আধুনিক ককটেল। একজন ড্রয়িংরুমের ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা টাটকা তাজা ফুল, অন্যজন পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকা বন্য ফুল। দু’জনকেই ফুটবলের দরকার।
গ্ল্যানভিলের এই দুটি মূল্যায়নই আমাকে ম্যারাডোনা ভক্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। পেলের খেলা আমি ফিল্মে, ভিডিওতে দেখেছি। ম্যারাডোনার খেলা স্টেডিয়ামে বসে দেখেছি ।
ওই আবেগ, ওই বন্য রোমান্টিকতা, ওই স্কিল আজও আমার মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে।
দিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে আমার প্রথম সশরীরে পরিচয় ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে রোমের থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ট্রেগোরিয়ায় আর্জেন্টিনার ট্রেনিং ক্যাম্পে। ম্যারাডোনা সেদিন প্রথম অনুশীলনে নামেননি। একটি বলের ওপর বসেছিলেন। এক আর্জেন্টাইন সাংবাদিক দুই ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচিত হতেই দুর্বোধ্য স্প্যানিশ ভাষায় বলে যাচ্ছিলেন। আর্জেন্টাইন সাংবাদিক তর্জমায় যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়, ম্যারাডোনার নখের একটি হার প্রজেক্টেড হয়ে যাওয়ার জন্যে তিনি স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছেন না। ভাবুন ব্যাপারটা, ম্যারাডোনা কাদের বোঝাচ্ছেন? এমন একটি দেশের সাংবাদিকদের যাদের দেশ ফুটবল এর প্রথম একশোতেও নেই। এমনই ছিল তাঁর সারল্য। আমরা সেবারই ইতালি – আর্জেন্টিনা ম্যাচ দেখতে রোম থেকে নাপোলি গিয়েছিলাম।
মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী আমার সঙ্গী ছিলেন। জানিনা, মতি ভাইয়ের স্মৃতিতে তা এখনও উজ্জ্বল কিনা ! সেদিন গ্যালারিতে বসে এক ভারতীয় ও এক বাংলাদেশি অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল ম্যারাডোনার অফ দ বল একটা সোলো রান, একজন ইতালিয় ডিফেন্ডার ম্যারাডোনার পিছনে ছুটলেন, সেই সুযোগে কানিজিয়া গোল করে হারালেন ইতালিকে। ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে ম্যারাডোনার কান্না ভুলতে পারিনি। ম্যারাডোনা ইতালিতে থাকার সময়েই মাফিয়াদের বন্ধু হয়ে ওঠেন এবং ড্রাগে অভ্যস্ত হন। ওই সময় থেকেই ফুটবলের রাজপুত্রের পদস্খলন। স্ত্রী ক্লদিয়া ভেল্লাফেনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি সেই সময়েই। নিত্যনতুন বান্ধবী, ড্রাগ, মদে ডুবে গেলেন ম্যারাডোনা। ১৯৯৪-তে নিষিদ্ধ ড্রাগ এফিড্রিন নিয়ে মাঠে নামার জন্য বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে নির্বাসিত হলেন বরণ্য এই খেলোয়াড়। আটাত্তরের কিশোর ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপের থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিংবদন্তী কোচ লুই সিজার মেনোত্তি। বিরাশিতে স্পেন বিশ্বকাপ দেখলো ম্যারাডোনার পায়ের জাদু। ছিয়াশির বিশ্বকাপে হ্যান্ড অফ গড এর মালিন্য ছাড়াও সাতজনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনার গোল করার অসাধারণ মুহূর্তটা বিশ্বকাপের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। উনিশশো আটানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা খেলেননি। তিনি তখন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু প্যারিসের মিডিয়া সেন্টারে আমরা সাংবাদিকরা শবরীর প্রতীক্ষায় ছিলাম। ম্যারাডোনা না থাকা মানে তো নুন ছাড়া মাংস। ম্যারাডোনা টুর্নামেন্টের মাঝপথে এলেন আর্জেন্টিনা রেডিও থ্রি এর ধারাভাষ্যকার হিসেবে এবং প্রথম দিনেই খবর হলেন প্যারিসের স্টাড দ ফ্রাসেতে তাঁর দেহরক্ষীকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে না দেয়ায় অবস্থান বিক্ষোভ করায়। শেষ পর্যন্ত ম্যারাডোনা হাফটাইমের পর ভাষ্য শুরু করলেন। আর আমি, এক ভারতীয় সাংবাদিক স্টেডিয়ামের গেটে দাঁড়িয়ে দেখলাম এক অসাধারণ টিমম্যানকে যিনি খেলা ছাড়ার পরও তার দলের সদস্যদের জন্যে সমান যত্নবান। সেবারই প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সেন্টারে ভোটাভুটি চলছিল- বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় কে? পেলে না ম্যারাডোনা! হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। হঠাৎ শেষদিকে পেলে কিছু ভোটে এগিয়ে গেলেন। ওমনি দেখি, ম্যারাডোনা হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ছুটে গেলাম পিছনে পিছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ম্যারাডোনা সাংবাদিক সম্মেলন করলেন – পেলে ফিফার মানসপুত্র, চোট্টামি করে ওকে জেতানো হলো। আই আম দ্য গ্রেটেস্ট। শিশুর মতো হাত পা ছুড়ছিলেন ম্যারাডোনা। সেদিন তার মধ্যেকার শিশুটিকে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম।
এরপর ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া – জাপানের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে পেয়েছিলাম দু’ দেশেরই মিডিয়া বক্সে। বিশ্ববিখ্যাত লা মন্ড সংবাদপত্রের জন্যে কলম ধরেছিলেন তিনি। মিডিয়া সেন্টারে, তা টোকিও হোক বা সিওল, ম্যারাডোনা যখন মিডিয়া সেন্টারে আসতেন তখন তাঁকে দেখেছি এক স্নেহশীল ভূমিকায়। সাংবাদিকদের যেকোনও মুভ বুঝিয়ে দিতেন সহজ সাবলীলভাবে।
এরপরে ম্যারাডোনা কোচ হয়েছেন, কোচের পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, দুহাজার আট আর সতেরোতে কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু, অনিয়ন্ত্রিত, অসংযমী জীবন ম্যারাডোনাকে শেষ করে দিয়েছে। ক্লদিয়া ভেল্লাফেনের সঙ্গে বিচ্ছেদ, মেয়ের থেকে কমবয়েসী এক তরুণীর পানিগ্রহণ। হাসিস, মারিজুয়ানা, এল এস ডির পঙ্কিল জীবন। হাভানা চুরুটের ধুম্রজালে হারিয়ে গেছেন ম্যারাডোনা। তবে, আমি তাঁকে, শুধু আমি কেন, গোটা বিশ্ব ম্যারাডোনার সেই চেহারা মনে রাখবে যেখানে তিনি চ্যাম্পিয়ন অফ দ্য চ্যাম্পিয়ন্স।
চ্যাম্পিয়ন চলে গেলেন মাত্র ষাট বছর বয়েসে। এই বয়সটা নিষ্ক্রান্তির বয়স নয়। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জীবন ম্যারাডোনার জীবনে যতি টানলো। রেফারি খেলা শেষের হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। গোল করার পর ম্যারাডোনাকে দেখেছি দু’ হাত দিয়ে বুক চাপড়াতে। স্বর্গে কি তিনি ওইভাবেই বুক চাপড়াবেন ফেলে আসা জীবনটার জন্য? ম্যারাডোনার এক মেয়ে ডালমার দুধের দাঁত দিয়ে ম্যারাডোনা কানের দুল বানিয়েছিলেন। সেই আদরের ডালমা, গিয়ানিনিরা থেকে গেল। বিশ্ব হয়তো আঙ্গুল দিয়ে ওদের দেখিয়ে বলবে, ওই দেখ, দুনিয়ার সব থেকে প্রতিভাধর, বোহেমিয়ান ফুটবলার-এর মেয়েরা যাচ্ছে। ম্যারাডোনাকে দুনিয়া এভাবেই মনে রাখবে, একজন ফুটবলার যে জীবনটাকে জুয়া হিসেবেই খেলে গেল।